কিছুই লাগে না গাড়ি চালাতে!

গাড়ি চালাতে কিছুই লাগে না। ড্রাইভিং লাইসেন্স, রুট পারমিটের দরকার নেই। গাড়ির ফিটনেস না থাকলেও সমস্যা নেই। সবচেয়ে বিস্ময়কর তথ্য হচ্ছে পরিসংখ্যান নেই ফিটনেসবিহীন গাড়ির, চালকের সংখ্যা ও রুট পারমিটের। যেসব গাড়ির রুট পারমিট নেই, সেগুলো চলছে খোদ রাজধানীতেই। একই সঙ্গে ফিটনেস ছাড়াই যানবাহনগুলো দাপিয়ে বেড়াচ্ছে দেশের সর্বত্র। এর মূল কারণ প্রভাবশালীদের ছত্রছায়া।

বিআরটিএ, ট্রাফিক পুলিশ, এমনকি ভ্রাম্যমাণ আদালত কোনোভাবেই পরিবহন খাতের নৈরাজ্য দূর করতে পারছে না। এর জেরে অঘোরে প্রাণ হারাচ্ছে সাধারণ মানুষ।


কুর্মিটোলা হাসপাতালের সামনে দুটি বাসের রেষারেষিতে ছাত্রমৃত্যুর ঘটনায় সারাদেশ উত্তাল। এর জেরে ওই গাড়ি দুটির রেজিস্ট্রেশন বাতিল করা হয়েছে। অথচ গাড়ি দুটির একটির ফিটনেস নেই দুই বছর ধরে, অন্যটির রুট পারমিটই নেই। প্রাণহানি এবং দেশজুড়ে অস্থির পরিস্থিতির পর এখন ওই গাড়িগুলোর রেজিস্ট্রেশন ও রুট পারমিট বাতিল করল বিআরটিএ! তা ছাড়া ওই গাড়ির চালকদের কাছেও বাসের মতো ভারী যানবাহন চালনার লাইসেন্স ছিল না। তা হলে এতদিন কীভাবে চলল এসব গাড়ি? এ প্রশ্ন ঘুরেফিরে সামনে চলে আসছে। তার চেয়ে বড় কথা, অনুমোদন ছাড়াই কী পরিমাণ গাড়ি চলাচল করছে তার হিসাব কি আছে?

বিআরটিএর চেয়ারম্যান মশিয়ার রহমান আমাদের সময়কে বলেন, পরিবহন খাতের শৃঙ্খলা ফেরাতে সব ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। ঝুঁকিপূর্ণভাবে এবং আইনের ব্যত্যয় ঘটিয়ে গাড়ি চালানো যাবে না। এ জন্য ভ্রাম্যমাণ আদালতের কার্যক্রম আরও জোরদার করা হয়েছে।

জানা গেছে, রাজধানীতে বাস-মিনিবাস চলাচলের জন্য রুট রয়েছে ৩৫৯টি। এসব রুটে যানবাহন চলাচলের অনুমতি রয়েছে বাসের জন্য ৫ হাজার ২৪৭টি এবং মিনিবাসের জন্য ২ হাজার ৬৯২টি। সব মিলিয়ে ৭ হাজার ৯৩৯টি। এসব গাড়ির অধিকাংশের কেউ একক মালিক নন। চাঁদার বিনিময়ে সাধারণ বাসমালিকরা পরিবহনের অন্তর্ভুক্ত হন। এমনও আছেন, একটি বাসের মালিক দুই-তিনজন। সাম্প্রতিক দুর্ঘটনাকবলিত জাবালে নূরের একটি বাসের মালিক জাহাঙ্গীর আলম, অপরটির নাম বিআরটিএর খাতায় ব্যাংকের অন্তর্ভুক্ত হিসেবে দেখানো আছে।

যদিও দীর্ঘদিন ধরেই প্রতিযোগিতা ঠেকাতে বাসে ক্ষুদ্র বিনিয়োগ প্রথা বাতিলের চিন্তা করছে সরকার। এর মানে বড় কয়েকটি কোম্পানির আওতায় চলবে গাড়ি। চালক-হেলপাররা বেতন পাবেন মাসিক ভিত্তিতে। পৃথক মালিক না হওয়ায় উপরি উপার্জনের টার্গেট থাকবে না। বন্ধ হবে যাত্রী তোলার অসুস্থ প্রতিযোগিতা। কিন্তু উদ্যোগটি বাস্তবায়নে বড় বাধা প্রভাবশালীরা। দলীয় পরিচয়, আর্থিক লালসাসহ নানা কারণে পরিবহন খাতের শৃঙ্খলা ফেরানো যাচ্ছে না।

চলমান ছাত্র আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে গতকাল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পরিবহন খাতে শৃঙ্খলা ফেরাতে বেশ কয়েকটি উদ্যোগ নেওয়ার কথা তুলে ধরেছেন। সেখানে পরিবহন খাতে সংশ্লিষ্ট নৌমন্ত্রী, স্থানীয় সরকার প্রতিমন্ত্রীসহ নেতারা উপস্থিত ছিলেন। স্টপেজ থেকেই ড্রাইভিং লাইসেন্স, ফিটনেস ও রুট পারমিট যাচাইয়ের ব্যাপারে আশ্বাস দেওয়া হয়েছে ওই বৈঠকে।

পরিবহন খাতের নৈরাজ্য ঠেকাতে উদ্যোগটির দ্রুত বাস্তবায়ন চান সাধারণ মানুষ। তার আগে দরকার প্রভাবশালী ব্যক্তির অশুভ ছায়া থেকে রক্ষা করা। বিনা লাইসেন্সে গাড়ি চালানোর স্পর্ধা, রুট পারমিট ও ফিটনেস ছাড়া গাড়ি বের করার দীর্ঘদিনের চর্চা দূর করা জরুরি। দুর্ঘটনায় দেশজুড়ে সমালোচনার ঝড় উঠলে চালককে আটকের দৃষ্টান্তই বেশি চোখে পড়ে। কিন্তু পরিবহন মালিক তার গাড়িটি কার কাছে ছেড়ে দিচ্ছেন এবং তার গাড়ির কাগজপত্রের বৈধতা নিয়ে কখনো ভাবেন না। কারণ তারা পার পেয়ে যান প্রতিবারই।

বিআরটিএ সূত্র জানায়, ড্রাইভিং লাইসেন্স নবায়ন করতে পেশাদার চালকের প্রশিক্ষণ বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ৮৪ হাজার ১৯ জন চালককে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। এতে চালকরা গাড়ি চালানোর কলাকৌশল, আচরণসহ সবকিছু শিখতে পারে। অথচ বাসমালিকরা তাদের চালককে প্রশিক্ষণে পাঠাতে অনাগ্রহী।

দেশে মোট পেশাদার চালকের সংখ্যা ১২ লাখ ১৫ হাজার ৪৭০ জন। অপেশাদার চালক আছেন ১৪ লাখ ২৪ হাজার ১৮৮ জন। সব মিলিয়ে ২৬ লাখ ৩৯ হাজার ৬৫৮ জন। তবে একই চালকের একাধিক লাইসেন্সের হিসাব বাদ দিলে মোট ড্রাইভিং লাইসেন্সের সংখ্যা দাঁড়ায় ১৯ লাখ ৪০ হাজার ৩৮১টি। পেশাদার লাইসেন্সের মধ্যে ভারী লাইসেন্স রয়েছে ১ লাখ ৩৮ হাজার ৫৯৭টি, মাঝারি লাইসেন্স ৬০ হাজার ২৩৮, হালকা ৮ লাখ ৫৭ হাজার ৯৮৯টি এবং থ্রি-হুইলার গাড়ি চালনার লাইসেন্স রয়েছে ৫৪ হাজার ৪৮৪টি। অপেশাদার লাইসেন্সের মধ্যে মোটরসাইকেলের জন্য ৮ লাখ ২৩ হাজার ১৩৫ এবং হালকা যানের জন্য লাইসেন্স রয়েছে ৬ লাখ ১ হাজার ৫৩টি।

জানা গেছে, সারাদেশে ৩৫ লাখ ৪৪ হাজার ৯টি গাড়ির রেজিস্ট্রেশন রয়েছে। এর মধ্যে ঢাকায় রেজিস্ট্রেশন করা গাড়ি ১৩ লাখ ৮ হাজার ৯৩০টি। সারাদেশে মোট ৫ লাখ ২ হাজার ১৩টি ফিটনেসবিহীন গাড়ি রয়েছে। এর মধ্যে বাস ২২ হাজার ৬৮৮, মিনিবাস ১২ হাজার ৯৭৫, হিউম্যান হলার ১৩ হাজার ১৩৪, ট্রাক ৬০ হাজার ৭০৯, কাভার্ড ভ্যান ৫ হাজার ৫৮১টি। সড়কগুলোয় বাস-মিনিবাস, হিউম্যান হলার এবং সিএনজি অটোরিকশার নৈরাজ্য সবচেয়ে বেশি। দুর্ঘটনায় দেশজুড়ে তোলপাড় হলে চলে লোকদেখানো কিছু পদক্ষেপ। এরপর বছরজুড়ে পরিবহনকর্মীদের নৈরাজ্য মেনে নিতে হয় সর্বসাধারণের। নীরবে ঝরতে থাকে প্রাণ।